ব্রেন টিউমার এমন একটি জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা, যা মস্তিষ্কের ভেতরে বা আশেপাশে অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধি থেকে তৈরি হয়। আমাদের মস্তিষ্ক শরীরের নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র, এখানেই স্মৃতি, চিন্তা, আবেগ, নড়াচড়া এবং প্রতিটি কার্যকলাপের সংকেত তৈরি হয়।
তাই মস্তিষ্কে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে তা শরীরের অন্যান্য অংশেও প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ব্রেন টিউমার এখন একটি বাড়তে থাকা স্বাস্থ্য সমস্যা। সমস্যা হচ্ছে অনেকেই শুরুতে সাধারণ মাথাব্যথা বা ক্লান্তি ভেবে এটিকে এড়িয়ে যান। এই সাধারণ মাথা ব্যথা থেকেই হয়ে যেতে পারে অনেক বড় কিছু, তাই শরীরের যেকোনো সমস্যার
তাৎক্ষনিক চিকিৎসা নেওয়া ভালো। আর প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা গেলে টিউমারের চিকিৎসা অনেক সহজ হয়ে যায়।
এই ব্লগে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব—ব্রেন টিউমার কী, এর কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে।
মস্তিষ্কের ভেতরে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হলে তাকে ব্রেন টিউমার বলা হয়। এটি মস্তিষ্কের বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হতে পারে; যেমন সেরিব্রাম, সেরিবেলাম বা ব্রেইনস্টেম। টিউমার সাধারণত দুই ধরনের হয়:
Benign (সৌম্য টিউমার): ধীরে ধীরে বাড়ে, সাধারণত ক্যান্সার নয় এবং অনেক ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সরানো যায়।
Malignant (ক্যান্সারজনিত টিউমার): দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং মস্তিষ্কের আশপাশের সুস্থ কোষ ধ্বংস করে ফেলে।
নোট:ব্রেন টিউমার যে কোনো বয়সে হতে পারে, তবে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এর ঝুঁকি বেশি। শিশুদের মধ্যেও কিছু বিশেষ ধরনের টিউমার দেখা যায়।
ব্রেন টিউমারের কারণ
মস্তিষ্কের কোষ কেন হঠাৎ করে অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে শুরু করে, সেটি জটিল বিষয়। তবুও কিছু অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কারণ টিউমার গঠনের ঝুঁকি বাড়ায়। ব্রেন টিউমারের সঠিক কারণ পুরোপুরি না জানা গেলেও গবেষকরা কিছু ঝুঁকিপূর্ণ কারণ চিহ্নিত করেছেন। সম্ভাব্য
কারণগুলো হলো:
জেনেটিক বা বংশগত প্রভাব: পরিবারে আগে থেকে ক্যান্সার বা টিউমারের ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি বাড়ে।
রেডিয়েশন এক্সপোজার: দীর্ঘ সময় রেডিয়েশনের সংস্পর্শে থাকা টিউমার সৃষ্টি করতে পারে।
ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হওয়া: দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতা শরীরে অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করে।
সেকেন্ডারি টিউমার: শরীরের অন্য কোনো জায়গার ক্যান্সার কোষ মস্তিষ্কে ছড়িয়ে এ ধরনের টিউমার তৈরি করতে পারে।
ব্রেন টিউমারের সাধারণ লক্ষণ
ব্রেন টিউমারের উপসর্গ অনেক সময় সাধারণ রোগের মতো মনে হয়। তবে ধীরে ধীরে এগুলো তীব্র আকার নেয় এবং দৈনন্দিন জীবনকে বাধাগ্রস্ত করে। প্রধান লক্ষণগুলো হলো:
দীর্ঘস্থায়ী বা অস্বাভাবিক মাথাব্যথা, যা দিনে দিনে বেড়ে যায়
সকালবেলায় ঘন ঘন বমি বা বমিভাব
চোখে ঝাপসা দেখা বা দ্বিগুণ দেখা
শরীরের একপাশ দুর্বল বা অসাড় হয়ে যাওয়া
খিঁচুনি বা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়া বা মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা
হাঁটতে গিয়ে ভারসাম্য হারানো
অস্বাভাবিক আচরণ বা মানসিক পরিবর্তন
ব্রেন টিউমার কীভাবে শনাক্ত করা যায়
সঠিক চিকিৎসার জন্য টিউমার দ্রুত শনাক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য আধুনিক ইমেজিং টেস্ট ও ল্যাবরেটরি পরীক্ষার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। নিচে টিউমার শনাক্তকরণের কিছু পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো:
MRI বা CT Scan: মস্তিষ্কের ভেতরে টিউমারের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করতে সাহায্য করে।
Biopsy: টিউমারের কোষ সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়, এতে টিউমার ক্যান্সারজনিত কি না বোঝা যায়।
Neurological Exam: দৃষ্টি, শ্রবণ, স্মৃতি ও ভারসাম্য পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়।
ব্রেন টিউমারের চিকিৎসা
টিউমারের ধরন, আকার ও অবস্থান অনুযায়ী চিকিৎসা নির্ধারণ করা হয়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে বর্তমানে অনেক রোগী সুস্থ জীবন ফিরে পাচ্ছেন। টিউমারের যে চিকিৎসাগুলো অধিক কার্যকারী, তা নিচে উল্লেখ করা হলো:
অস্ত্রোপচার (Surgery): টিউমার সম্পূর্ণ বা আংশিক সরানো হয়।
রেডিয়েশন থেরাপি: ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রশ্মি ব্যবহার করা হয়।
কেমোথেরাপি: ওষুধের মাধ্যমে টিউমার কোষ ধ্বংস করা হয়।
টার্গেটেড থেরাপি: নির্দিষ্ট জেনেটিক পরিবর্তনকৃত কোষের বিরুদ্ধে চিকিৎসা করা হয়।
ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত রোগীর পরিচর্যা
টিউমারে আক্রান্ত রোগীর জন্য শুধুমাত্র চিকিৎসাই যথেষ্ট নয়, বরং রোগীর মানসিক ও শারীরিক সাপোর্টও প্রয়োজন। সুস্থ জীবনে ফিরতে কিছু বিষয় মেনে চলা দরকার।
স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া
নিয়মিত ঘুম ও বিশ্রাম নেওয়া
হালকা ব্যায়াম করা
মানসিক চাপ কমানো
চিকিৎসকের নিয়মিত ফলোআপ নেওয়া
কখন ডাক্তার দেখাবেন?
অনেকেই সাধারণ মাথাব্যথা বা ক্লান্তিকে গুরুত্ব দেন না। কিন্তু কিছু লক্ষণ অবহেলা করলে তা বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই সঠিক সময়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া জরুরি। নিচের পরিস্থিতি দেখা দিলে দ্রুত নিউরোসার্জনের পরামর্শ নিতে হবে:
হঠাৎ তীব্র মাথাব্যথা শুরু হলে
খিঁচুনি বা অজ্ঞান হয়ে গেলে
দৃষ্টিশক্তি বা কথাবার্তায় সমস্যা হলে
শরীরের একপাশ হঠাৎ দুর্বল হয়ে গেলে
একজন নিউরো-সার্জনের পরামর্শ নিন
ব্রেন টিউমার সন্দেহ হলে রোগীর পরিবার অনেক সময় দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়—কোন চিকিৎসকের কাছে যাবেন, কার কাছে সঠিক চিকিৎসা পাওয়া যাবে। আসলে, এমন গুরুতর রোগের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও দক্ষ নিউরো-সার্জনের পরামর্শ নেওয়া খুবই জরুরি।
বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ নিউরো-সার্জন রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসা দিয়ে আসছেন। তাদের মধ্যে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ শামসুল ইসলাম খান, যিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিউরোসার্জারি বিভাগে কর্মরত, দীর্ঘদিন ধরে ব্রেন টিউমারসহ
নানা জটিল মস্তিষ্ক ও স্নায়ুরোগের সফল চিকিৎসা করে আসছেন।
টানা মাথাব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, শরীরের একপাশ দুর্বল হয়ে যাওয়া, খিঁচুনি বা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া—এসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
ব্রেন টিউমারের জন্য অভিজ্ঞ সার্জন কে?
ব্রেন টিউমারের চিকিৎসায় অবশ্যই অভিজ্ঞ নিউরো-সার্জনের পরামর্শ নিতে হবে। যেমন—অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ শামসুল ইসলাম খান, যিনি দীর্ঘদিন ধরে ব্রেন, স্পাইন ও স্নায়ু রোগের চিকিৎসা করে আসছেন।
ব্রেন টিউমার কি সবসময় ক্যান্সার?
না। সব টিউমার ক্যান্সার নয়। কিছু টিউমার benign (সৌম্য), যেগুলো ধীরে বাড়ে এবং অস্ত্রোপচারে সরানো যায়। তবে malignant টিউমার (ক্যান্সার) দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
ব্রেন টিউমার হলে চিকিৎসা কীভাবে হয়?
চিকিৎসার ধরন নির্ভর করে টিউমারের অবস্থান ও আকারের ওপর। সাধারণত সার্জারি, রেডিয়েশন থেরাপি, কেমোথেরাপি এবং কিছু ক্ষেত্রে টার্গেটেড থেরাপি দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে ব্রেন টিউমারের চিকিৎসা কোথায় পাওয়া যায়?
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন বড় হাসপাতালে এ চিকিৎসা পাওয়া যায়। অভিজ্ঞ নিউরো-সার্জনের অধীনে চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।